ঢাকা , বুধবার, ০২ এপ্রিল ২০২৫ , ১৯ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

রাজনৈতিক দলগুলো আগে কী চায়, নির্বাচন নাকি সংস্কার?

আপলোড সময় : ০১-০৪-২০২৫ ০১:৪৬:৪২ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ০১-০৪-২০২৫ ০১:৪৬:৪২ অপরাহ্ন
রাজনৈতিক দলগুলো আগে কী চায়, নির্বাচন নাকি সংস্কার?
এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায়। বিএনপি, জামায়াতসহ পুরনো দলগুলোর নেতারা নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় প্রচারণায় মগ্ন, তবে এবারের মাঠে ‘সরকারি দল’ হিসেবে কেউ নেই। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের অনেকেও আত্মগোপনে বা এলাকা থেকে দূরে। ফলে, রাজনৈতিক মাঠ অনেকটা আওয়ামী লীগশূন্য। তবুও কয়েক মাসে, গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ বেড়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে ইফতার মাহফিলগুলোতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে। তবে, কিছুটা হলেও রাজনৈতিক সৌজন্যতা রক্ষায় দলগুলো একে অপরকে ইফতার আয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং অংশগ্রহণও করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে— ঈদের পর নির্বাচনী প্রচারণা এবং সংস্কারের ইস্যুতে বড় ধরনের মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো আগে কী চায়, নির্বাচন নাকি সংস্কার?

গেল ২৫ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে। আমরা চাই, নির্বাচনটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হোক। নির্বাচন কমিশন সেই হিসেবে প্রস্তুতি নিচ্ছে, এবং আমরা আশা করছি— রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবে।’

বিএনপির অবস্থান: দ্রুত নির্বাচন, স্পষ্ট রোডম্যাপ

বিএনপি তাদের অবস্থান জানিয়ে বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যদি দ্রুত নির্বাচন না হয়, তাহলে তারা আন্দোলন শুরু করবে। দলটি বারবার নির্বাচনের জন্য স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা দাবি করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের বিষয়ে দেওয়া বক্তব্য অস্পষ্ট। ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের মধ্যে যদি নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়া হয়, তবে সংকট কাটবে না। আমরা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।’

বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেই এবং তারা বিভিন্ন সময় নির্বাচনের ব্যাপারে অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিয়ে আসছে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘দেশে যে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে, তা শুধু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারই সমাধান করতে পারবে। আমাদের দাবি— দ্রুত নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করুন, আর তা না হলে আমরা আন্দোলন শুরু করব।’

বিএনপির একাধিক নেতার বক্তব্য অনুযায়ী, সরকার নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে এবং রাজনৈতিক সংকট কাটাতে যে সংস্কারের দাবি করা হয়েছে, তা কার্যকরভাবে করতে হবে।

এনসিপি: সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হবে না

সদ্য প্রতিষ্ঠিত দল এনসিপিও (ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টি) নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। দলটির দাবি— আগে সংস্কার এবং বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে, এরপরই নির্বাচন সম্ভব। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন হতে পারে না। আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন নিয়ে কাজ করছি। ঈদের পর আমাদের আন্দোলন শুরু হবে।’

এনসিপি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি তৈরির চেষ্টা করছে এবং দেশের জনগণের মধ্যে তাদের দাবি পৌঁছাতে বিভিন্ন আন্দোলন ও কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে। তারা জানাচ্ছে, ‘আমরা সংস্কার এবং বিচার নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি, যা জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে।’

এনসিপি মনে করছে, সরকার যদি দ্রুত সংস্কার কার্যকর না করে, তবে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়বে। তবে দলটি আশাবাদী যে, সকল দল যদি আন্তরিক থাকে, তাহলে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।

জামায়াতে ইসলামী: নির্বাচন ও সংস্কার সমান গুরুত্বপূর্ণ

জামায়াতে ইসলামী মধ্যপন্থী অবস্থান নিয়ে নির্বাচন এবং সংস্কার উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছে। দলটি মনে করছে, নির্বাচন ও সংস্কার দুইটি সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোর মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। জামায়াতে ইসলামী মনে করছে, সরকারের প্রতি আস্থা রেখে তারা আশা করছে, আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন এবং সংস্কার সম্ভব।

জামায়াতে ইসলামী এই মুহূর্তে আন্দোলনে না যাওয়ার পক্ষেই রয়েছে এবং বলছে যে, ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান করা উচিত। আন্দোলন এড়িয়ে চলা ভালো হবে, কারণ সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন করে চলে যাবে, এবং এতে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।’

তবে জামায়াতে ইসলামী তাদের রাজনৈতিক অবস্থানে এখনও স্পষ্টতা রাখছে না, এবং সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই পরিস্থিতি সমাধান করা যেতে পারে বলে মনে করছে। তারা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে, এটিই সঠিক সময় মনে করি আমরা।’

সরকারের অবস্থান: অনিশ্চয়তা ও প্রস্তুতির অভাব

সরকারের অবস্থান নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ মনে করেন, সরকার আসলে দ্রুত নির্বাচন দিতে চায় না। তিনি বলেন, ‘যতটা প্রস্তুতি থাকা দরকার, সরকারের মধ্যে সেটা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের এই অবস্থান নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে। এমনকি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকবে কিনা, তা নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ না থাকলে, কীভাবে থাকবে না তাও বলা হচ্ছে না। নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে সরকার একটা চালাকি করছে।’

সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি

এদিকে, সিপিবি (কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করেই নির্বাচন দেওয়া উচিত। সংস্কার নিয়ে যত দেরি হবে, ততই জটিলতা সৃষ্টি হবে। প্রয়োজনে আন্দোলনে নামতে হবে।’

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী অভিযোগ করেছেন, সরকার সংস্কারের কাজ মন্থর গতিতে করছে এবং তা গণতান্ত্রিকভাবে ইনক্লুসিভ উপায়ে হচ্ছে না। তার মতে— সরকার যদি সংস্কার দ্রুত শেষ না করে, তবে তা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করবে।

রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা

ড. সাব্বির আহমেদ আরও বলেন, ‘বিএনপি এবং এনসিপির মধ্যে যদি কর্মসূচি নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়, তা সংঘাতের কারণ হতে পারে। বিএনপি একটি বড় দল এবং তাদের মবিলাইজেশন ক্ষমতা অনেক বেশি। অন্যদিকে, এনসিপিও রাজনৈতিক মাঠে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠছে। এই অবস্থায় যদি দুই দলের মধ্যে সংঘাত হয়, তা রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে।

নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ